করোনায় মারা গেলে শহীদের মর্যাদা পাবেন যারা
করোনা ভাইরাসের মত মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে তিনি কী শহীদের মর্যাদা পাবেন? উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এই প্রশ্নটি আমাদের কাছে অনেকেই জানতে চেয়েছেন। সচেতন মুসলিম হিসেবে এমন প্রশ্ন মনের ভেতর জেগে ওঠা খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। তো আসুন, আজ আমরা জেনে নিই, এ সম্পর্কে ইসলাম আমাদের কী বলে।
সাধারণত কাফিরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে নিহত ব্যক্তিকেই শহীদ মনে করা হয়। যদিও মহানবি (সা.) উক্ত ব্যক্তি ছাড়া আরও অনেক মৃতকে শহীদি মর্যাদা লাভের সুসংবাদ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি এমন সব মৃত ব্যক্তিকেও শহীদ হিসেবে গণ্য করেছেন, যাদের মৃত্যুকে সাধারণত ‘অপমৃত্যু’ বলে মনে করা হয় (নাউজুবিল্লাহ)। অবশ্য সশস্ত্র যুদ্ধে নিহত শহীদ আর অন্যান্য শহীদের মধ্যে মর্যাদার তারতম্য থাকবে। এখানে উভয় প্রকার শহীদের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হলো:
হাকিকি বা প্রকৃত শহীদ হওয়ার শর্ত
মৃত ব্যক্তিকে গোসল করানো ও কাফন দেওয়ার দিক বিবেচনায় শহীদ দুই প্রকার। ১. হাকিকি বা প্রকৃত শহীদ। যিনি দুনিয়া-আখেরাত উভয় বিচারে শহীদ। তাকে গোসল করানো হয় না। কাফন দেওয়া হয় না। বরং যে কাপড়ে সে শহীদ হয়েছে, সে কাপড়েই জানাজা পড়ে দাফন করা হয়।
২. হুকমি বা বিধানগত শহীদ। যিনি নবি করিমের (সা.) সুসংবাদ মোতাবেক পরকালে শহীদের মর্যাদা লাভ করবেন। কিন্তু পৃথিবীতে তার ওপর প্রথম প্রকার শহীদের বিধান জারি হবে না। অর্থাৎ সাধারণ মৃত ব্যক্তির মতো তাঁকেও গোসল-কাফন ইত্যাদি দেওয়া হবে।
তবে নিম্নোক্ত শর্তাবলি পাওয়া গেলে তাকে হাকিকি শহীদ বলে গণ্য করা হবে:
- (ক) মুসলমান হওয়া।
- (খ) প্রাপ্তবয়স্ক ও বোধসম্পন্ন হওয়া।
- (গ) গোসল ফরজ হয়, এমন নাপাকি থেকে পবিত্র হওয়া।
- (ঘ) বেকসুর নিহত হওয়া।
- (ঙ) মুসলমান বা জিম্মির হাতে নিহত হলে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হওয়াও শর্ত। আর যুদ্ধ কবলিত এলাকায় কাফিরের হাতে অথবা ইসলামি খিলাফতের বিদ্রোহী ডাকাতের হাতে নিহত হলে ধারালো অস্ত্রের আঘাত শর্ত নয়।
- (চ) এমনভাবে নিহত হওয়া যার শাস্তি স্বরূপ প্রাথমিক পর্যায়েই হত্যাকারীর ওপর কিসাসের বিধান আরোপিত হয়।
- (ছ) আহত হওয়ার পর কোনোরূপ চিকিৎসা ও জীবনধারণের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়াদি যেমন- খানাপিনা, ঘুমানো ইত্যাদির সুযোগ না পাওয়া। হুঁশ অবস্থায় তার ওপর এক ওয়াক্ত নামাজের সময় অতিবাহিত না হওয়া। পদদলিত হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে হুঁশ অবস্থায় লড়াইয়ের ময়দান থেকে তাকে উঠিয়ে না আনা।
হুকমি বা বিধানগত শহীদ যারা
- (১) এমন নিহত ব্যক্তি যার মধ্যে প্রথম প্রকার শহীদের শর্তাবলির কোনো একটি পাওয়া যায়নি। (রদ্দুল মুহতার-২/২৫২)
- (২) কাফির, বিদ্রোহী বা ডাকাতের ওপর কৃত আক্রমণ উল্টে এসে আক্রমণকারীকেই আঘাত করেছে এবং এ আঘাতেই আক্রমণকারী নিহত হয়েছে। (সহিহ বুখারি-৩/১০২৭ পৃ: হা: ৪১৯৬)
- (৩) ইসলামি রাষ্ট্রের সীমানারক্ষী, ডিউটিকালীন যার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। (সহিহ মুসলিম-৩/১৫২০ পৃ: হা: ১৯১৩)
- (৪) আল্লাহর পথে শাহাদত লাভের প্রার্থনাকারী, কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যু তার সে বাসনা পূর্ণ করেনি। (সহিহ মুসলিম-৩/১৫১পৃ: হা: ১৯০৯)
- (৫) জালিমের সঙ্গে অথবা নিজ পরিবার হেফাজতের লড়াইয়ে মৃত্যুবরণকারী। (আহমদ-১/১৯০পৃ: হা: ১৬৫৭)
- (৬) নিজের জান-মাল ছাড়িয়ে আনা বা রক্ষা করার লড়াইয়ে নিহত ব্যক্তি। (আহমদ-১/১৮৭ পৃ: ১৬৩৩)
- (৭) মজলুম রাজবন্দী। বন্দিদশাই যার মৃত্যুর কারণ। (উমদাতুল ক্বারী-১০/১৪৪পৃ:)
- (৮) নির্যাতনের ভয়ে আত্মগোপনকারী। যার এ অবস্থায় মৃত্যু এসে গেছে।
- (৯) মহামারিতে মৃত্যুবরণকারী। এ মর্যাদা সে ব্যক্তিও লাভ করবে যে মহামারি চালাকালীন আক্রান্ত এলাকায় সওয়াবের নিয়তে ধৈর্য্য ধরে অবস্থান করে এবং সে সময় স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে। (সহিহ বুখারি ১/১৬২পৃ: হা: ৬৫৩)
- (১০) ডায়রিয়ায় বা পেটের পীড়ায় মৃত্যুবরণকারী। (সহিহ বুখারি শরিফ ১/১৬২ পৃ. হা:৬৫৩)
- (১১) নিউমোনিয়ায় মৃত্যুবরণকারী। (মাজমাউয যাওয়াইদ-৫/৩৮৯পৃ. হা: ৯৫৫৪)
- (১২) ذات الجنب অর্থাৎ প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তিও শহীদ। (সুনানে ইবনে মাজাহ-৩/৩৬৬ পৃ. হা: ২৮০৩)
- (১৩) মৃগী রোগে বা বাহন হতে পড়ে মৃত্যুবরণকারী। (মুসতাদরাকে হাকেম-৩/৯০৯ পৃ. হা: ২৪১৬)
- (১৪) জ্বরে ভুগে মৃত্যুবরণকারী। (উমদাতুল ক্বারী-১০/১৪৫)
- (১৫) সি সিকনেস বা সমুদ্র দুলুনীতে মাথা ঘুরে বমি করে মৃত্যুবরণকারী। (সুনানে আবূ দাউদ-২/১০পৃ. হা: ২৪৯৩)
- (১৬) যে ব্যক্তি রোগ শয্যায় ৪০ বার ‘লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনায যলিমীন’ পড়ে এবং ওই রোগেই পরপারে পাড়ি জমায়।
- (১৭) যে দম বন্ধ হয়ে মারা গেছে।
- (১৮) বিষাক্ত প্রাণীর দংশনে যার মৃত্যু হয়েছে। (মুসতাদরকুল হাকেম-৩/৯০৯পৃ. হা: ২৪১৬)
- (১৯) হিংস্র প্রাণী যাকে ছিঁড়ে মেরে ফেলেছে। (মাজমাউয যাওয়াউদ-৫/৩৯০পৃ. হা: ৯৫৫৯)
- (২০) পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণকারী। (সহিহ বুখারি-১/১৬২পৃ. হা: ৬৫৩)
- (২১) অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণকারী। (ইবনে মাজাহ-৩/৩৬৬পৃ. হা: ২৮০৩)
- (২২) বিল্ডিং ধ্বসে বা দেয়াল চাপা পড়ে নিহত ব্যক্তি। (সহিহ বুখারি ১/১৬২পৃ. হা: ৬৫৩)
- (২৩) গর্ভবতী মৃত স্ত্রীলোক। (ইবনে মাজাহ-৩/৩৬৬পৃ. হা: ২৮০৩)
- (২৪) সন্তান প্রসবকালে মৃত্যুবরণকারী অথবা প্রসবান্তে নেফাস চলাকালীন মৃত্যুবরণকারীনী। (ইবনে মাজাহ-৩/৩৬৬পৃ. হা: ২৮০৩)
- (২৫) কুমারী অবস্থায় মৃত্যুবরণকারীনী। (সুনানে ইবনে মাজাহ-৩/৩৬৬পৃ. হা: ২৮০৩)
- (২৬) প্রবাসে-পরদেশে মৃত্যুবরণকারী। (ফাতহুল বারী-৬/৫৬পৃ.)
- (২৭) ইলমে দীন চর্চায় লিপ্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী। (উমদাতুল ক্বারী-১০/১৪৫)
- (২৮) সওয়াবের আশায় আজান দেয় যে মুয়াজ্জিন। (আত্তারগিব ওয়াত তারহিব-১/১২৯পৃ. হা: ৩৬৪)
- (২৯) যে ব্যক্তি বিবি বাচ্চার হক যথাযথ আদায় করে এবং তাদের হালাল খাওয়ায়।
- (৩০) সত্যবাদী আমানতদার ব্যবসায়ী। (সুনানে তিরমিজি-১/৩৭৭পৃ. হা: ১২১২)
- (৩১) মুসলমানদের শহরে খাদ্য আমদানিকারক ব্যবসায়ী।
- (৩২) মানুষের সঙ্গে সদ্ব্যবহারকারী। যে শরয়ি প্রয়োজন ছাড়া মন্দ লোকের সঙ্গেও মন্দ আচরণ করে না।
- (৩৩) উম্মতের ফেতনা-ফাসাদের সময়ও যিনি সুন্নাতের ওপর অটল থাকেন। (মেশকাত ১/৫৫পৃ. হা: ১৭৬)
- (৩৪) যিনি রাত্রিবেলায় অজু করে শয়ন করেন এবং ওই ঘুমেই তার মৃত্যু এসে যায়। (উমদাতুল ক্বারী-১০/১৪৫প.)
- (৩৫) জুমার দিনে মৃত্যুবরণকারী। (উমদাতুল ক্বারী-১০/১৪৫প.)
- (৩৬) দৈনিক পঁচিশবার এই দোয়া পাঠকারী ‘আল্লাহুম্মা বারিক লি ফিল মাওতি ওয়া ফিমা বাদাল মাওতি।’ (মেরকাত : ৫/২৭০)
- (৩৭) দৈনিক চাশতের নামাজ আদায়কারী। মাসে ৩ রোজা পালনকারী এবং ঘরে-সফরে সর্বদা বিতরের নামাজ আদায়কারী। (উমদাতুল ক্বারী-১০/১৪৫প.)
- (৩৮) প্রতি রাতে সুরা ইয়াসিন তিলাওয়াতকারী।
- (৩৯) দৈনিক একশত বার দুুরুদ পাঠকারী। (ত্ববরানী ফিল আওসাতি-৫/২৫২,পৃ.৭২৩৫)
- (৪০) যে স্ত্রী তার সতিনের প্রতি তার স্বামীর (অন্যায়) ভালোবাসার দুঃখ সয়ে সয়ে মৃত্যুবরণ করে। (ফতওয়া শামি ২/২৫২, আহকামে মায়্যেত-১০১-১১২)
করোনায় মারা গেলে শহীদের মর্যাদা পাবেন যারা
Reviewed by Tottho Projukti
on
March 22, 2020
Rating: