প্রথম মুসলিম মঙ্গোল সম্রাট | সুলতান বারকে খান

সুলতান বারকে খান। প্রথম মুসলিম মঙ্গোল সম্রাট। মঙ্গোল নেতা চেঙ্গিস খানের নাতি। আব্বাসি খিলাফাত ধ্বংসকারী হালাকু খানের চাচাতো ভাই। জাহাবিয়্যাহ গোত্রধিপতি। এই জাহাবিয়্যাহ গোত্রটি তাতার সাম্রাজ্য থেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন ছিল। এটি কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণদিকে অবস্থিত এলাকা শাসন করত। ইসলামি ইতিহাসের পুরনো বইসমূহে এই এলাকাকে কাবজাক অঞ্চল বলা হত। যা বর্তমানে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত। তাতারিরা ইসলাম ও মুসলমানদের রক্তখেকো হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানরা তাদের মাঝে ইসলামের বাণী পৌঁছিয়ে দিতে কমতি করেননি। এদের মধ্যে শাইখ নাজমুদ্দিন কুবরার অনুসারীরা অন্যতম। আবার আগে থেকেই বারকে খান ইসলামের মহানুভবতায় বিমুগ্ধ ছিলেন। ফলে ৬৫০ হিজরি, মুতাবেক ১২৫২ খ্রিষ্টাব্দে বারকে খান শাইখ নাজমুদ্দিন কুবরার কোনো এক মুরিদের হাতে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয়গ্রহণ করেন।

মঙ্গোল সম্রাট


তার ইসলাম গ্রহণ করার সাথে সাথে জাহাবিয়্যাহ গোত্রের তাতারিরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে। ফলে মানব ইতিহাসের রক্তখেকো পিশাচ বলে পরিচিত এই লোকগুলো সোনার মানুষে পরিণত হয়ে যায়। ইসলাম গ্রহণ করার পরই বারকে চাচাতো ভাই নরপিশাচ হালাকু খানের কট্টর বিরোধীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। হালাকু খান কর্তৃক বাগদাদের আক্রমণ ঠেকাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। প্রধান কারণ, তাঁর বাহিনীর সেনারা নওমুসলিম ছিল। তখনও প্রতিমাপূজার চেতনা তাদের মাঝ থেকে পুরোপুরি দূর হয়নি। হালাকু খানের বিদ্রোহ করার হিম্মত তাদের ছিল না। তিনি মিশর ও শামের সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্সের সাথে বন্ধুপ্রতিম সম্পর্ক স্থাপন করেন। চিঠি চালাচালি করেন। তাঁর অসামান্য অবদানেই আইনে জালুত যুদ্ধে মামলুক বাহিনী হালাকু খানের তাতারি বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করে। তিনি আলেম ও আল্লাহওয়ালদের ভালোবাসতেন। বীর, ন্যায়নীতিবান ও সহমর্মী সম্রাট ছিলেন। ৬৬৫ হিজরিতে ইনতেকাল করেন।

একবার সুলতান বারকে খান কোনো একটি অঞ্চল পদানত করেন। যুদ্ধে জয়লাভ করার তিনি ওই অঞ্চলের শহর, নগর, বন্দর ও গ্রামগুলো সংস্কার করতে মনোনিবেশ করলেন। একটি গ্রামের পাশ দিয়ে তিনি অতিক্রম করতে গেলেন। এই গ্রামবাসী প্রতিমাপূজা করত। পুরো গ্রামটিই ছিল ধ্বংসের ভাগাড়। কোনো ঘড়বাড়িই চোখে পরিলক্ষিত হচ্ছিল না। কেবল একটি কুঁড়েঘর ছাড়া। এই কুঁড়েটি একজন যুবতীর। ঘরে সে ও তার ছোট্টছোট্ট কয়েকটি বোন বসবাস করে। এ অবস্থা দেখে যুবতীকে সুলতান বারকে খান জিজ্ঞেস করলন-
  • -গ্রামের লোকজন কোথায়?
  • -আপনাদের আগমনের খবর পেতেই ভয়ে তারা পলায়ন করেছে!
  • -তুমিও তাদের সাথে পলায়ন করলে না কেন?
  • -আমি জেনেছি যে, মুসলমানরা যখন কোনো জনপদে আক্রমন করে, তখন নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ ও বৈরাগীদের হত্যা করে না। তাই আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম। তাদের সাথে পলায়ন করিনি।
  • -তুমি যা বলেছো, আমাদের ধর্মে তা-ই সত্য। এখন তুমি এসব লোকদের কাছে খবর পাঠাও যে, তারা সম্পূর্ণ নিরাপদ। তাদের কোনো কষ্ট দেওয়া হবে না।

যুবতী আগুন প্রজ্বলন করল। আগুন থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উড়তে লাগল। পাহাড়-পর্বত ও বন-বাদাড়ে আশ্রিত গ্রামবাসী ধোঁয়া দেখে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসতে লাগল। সুলতান বারকে খান তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনার সাথে বরণ করে নিলেন। তাদের জান ও মালের নিরাপত্তা দান করলেন। তার এই মহান ব্যবহার দেখে গ্রামবাসী একেবারে বিমুগ্ধ হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ গোটা গ্রামবাসী দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয়গ্রহণ করল। তাতারিদের মাঝে ইসলামের প্রসার আরও ছড়িয়ে পড়ল।

হালাকুর সাথে যুদ্ধঃ
বারকি খানের ভাতিজা হালাকু খানের দায়িত্ব ছিল উত্তর পারস্যে শাসনকার্য পরিচালনা করা এবং পারস্য থেকে মিসর পর্যন্ত মঙ্গোল সাম্রাজ্য বিস্তারে তার ভাই মউঙ্গকে কে সহযোগিতা করা। ১২৫৬ সালে হালাকু খান প্রায় ১০০,০০০ সেনা নিয়ে যুদ্ধ আরম্ব করে। প্রথমেই তারা ইসলাইলি শিয়াদের দূর্গগুলো দখল করে নেয় এবং তাদের নেতা রুকনুদ্দিনকে বন্দী করে হত্যা করে। এরপর হালাকু খান ইরাকের দিকে এগিয়ে এসে খলিফা মুতাসিমকে আত্মসমর্পন ও মঙ্গোল সাম্রাজ্যের প্রতি আনুগত্যের আহবান জানালে খলিফা তা প্রত্যাখ্যান করে।

অবশেষে হালাকু ইরাক আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং খলিফা বিরোধী শিয়াদের নিজের দলে সামিল করে নিতে থাকে। শিয়া অধ্যুষিত নাজাফ, কারবালা, মসুল ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ন শহরগুলো যুদ্ধ ছাড়াই হালাকু খানের কাছে আত্মসমর্পন করে মঙ্গোল আধিপত্য মেনে নেয়। অবশেষে ১২৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণ করে এবং মাত্র দুই সপ্তাহের মাঝেই শহরের দখল নিয়ে নেয়। এক সময়ের আলোকিত শহর, জ্ঞান- বিজ্ঞানের শহর, শিল্প ও সাহিত্যের শহর বাগদাদের পতনের সাথে সাথেই খলিফা মুতাসিমকে হত্যা করা হয় এবং সমগ্র শহর জ্বালিয়ে ছাড়খার করে দেয়া হয় সেই সাথে পাল্লা দিয়ে চলে গণহত্যা।

বাগদাদের এ পতন সংবাদ যখন পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পৌছালো তারা ভয়ে যুদ্ধ না করেই হালাকুর কাছে আত্মসমর্পণ করল। এভাবেই সিরিয়া হালাকু খানের অঞ্চল হিসেবে পরিগণিত হয়ে গেল। বারকে খানের কাছে যখন বাগদাদে ঘটে যাওয়া রক্তাত্ব মুসলিম গণহত্যার কথা পৌছল তিনি রাগে ফেটে পরলেন এবং হালাকু খানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের অঙ্গীকার করে বললেনঃ “সে (হালাকু) মুসলিম জনপদগুলো ধ্বংস করেছে। আল্লাহর সহায়তায় অবশ্যই আমি তার কাছে থেকে প্রতিটি নিরপরাধ লোকের প্রতিশোধ নিব।”

বারকে খান হামলা করতে পারে এই ভয়ে হালাকু খান সিরিয়ায় ছোট্ট একটি গেরিসন রেখে পারস্যে চলে আসেন। ১২৬০ সালের মাঝে অধিকাংশ সিরিয়ান অঞ্চল এবং ফিলিস্তিন তাদের করতলগত হলেও তাদের এ বিজয়গাথায় ছন্দপতন ঘটে যখন মামলুক তুর্কি সুলতান কুতুজ তার সেনাপতি বাইবার্সকে ফিলিস্তিনে প্রেরণ করলে সে মঙ্গোলদের পরাজিত করে তাদের সেনাপ্রধানকে হত্যা করে। এভানেও পশ্চিমে মঙ্গোলদের অগ্রযাত্রা থমকে যায় এবং ফিলিস্তিন ও সিরিয়া আবারো মুসলিম মামলুকদের হাতে চলে আসে।

হালাকু খান চাচ্ছিলেন আবারো নতুন করে সেনা পাঠিয়ে ফিলিস্তিনে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে কিন্তু তার আর সম্ভব হয়নি কারণ ইতিমধ্যে মুসলিম মুসলিম গণহত্যার অপরাধের প্রতিশোধ নিতে বারকে খান হালাকু খানের ককেসাসিয়ান অঞ্চলে একের পর এক আক্রমণ করেই যাচ্ছিলেন যেন হালাকু খান তার কাছে নতি স্বীকার করে নেয়। বাগদাদের ঘটনার কারণে একমাত্র হালাকুর বিনাশ ছাড়া বারকে খান অন্য কিছুই মানতে চাচ্ছিলেন না। তাদের দুই জনের এই যুদ্ধ দ্রুতই সে অঞ্চলের আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নেয় এবং অন্যান্য কায়নাতও জোটবদ্ধ হয়ে আক্রমণে আসে। কুবলাই খান হালাকু খানের সাথে জোট বাঁধলে হালাকুর আরেক ভাই আরিকবুক বারকে খানের সাথে জোট বাঁধে। যুদ্ধ বর্তমান চায়না ও মঙ্গলীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পরে। যুদ্ধ শুরু হলে আরিকবুক দ্রুতই কুবলাই খার কাছে আত্মসমর্পন করে ফলে হালাকু ও বারকে উভয়েই যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

পূর্বাঞ্চলীয় কায়নাতের যে স্বপ্ন আরিকবুকের ছিল তা আর পূরণ হয়নি। তবে মধ্যপ্রাচ্য ও মিশর নিয়ে হালাকুর যে লুলুপ স্বপ্ন ছিল বারকে খান তা ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাদের এ যুদ্ধ ১২৬৫ সালে হালাকু এবং ১২৬৬ সালে বারকে খানের মৃত্যুর পরও চলছিল। পারস্যে হালাকু খান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইলখানাত রাজবংশ ১৩৩৫ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল এবং তার উত্তরসূরিরা ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এদিকে বারকে খানের মৃত্যুর পর তার ভাতিজা মেঙ্গু তিমুর শাসনভার গ্রহণ করে গোল্ডেন হর্দের খান নির্বাচিত হয়। হালাকু খানের বিরুদ্ধে পরিচালতিত যুদ্ধে বারকে খান সামগ্রিক জয় না পেলেও মিশরের মামলুক ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে হালাকু খানের দৃষ্টি ও যুদ্ধের মাঠ পূর্বে নিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলেন ফলে আর কোন মুসলিম জনপদকেই বাগদাদের করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়নি।
প্রথম মুসলিম মঙ্গোল সম্রাট | সুলতান বারকে খান প্রথম মুসলিম মঙ্গোল সম্রাট | সুলতান বারকে খান Reviewed by Tottho Projukti on May 08, 2020 Rating: 5
Powered by Blogger.