নাইটস টেম্পলারদের গোপন রহস্য
পৃথিবীর ইতিহাসে নাইটস টেম্পলারদের মতো আলোড়ন তোলা গুপ্ত সংগঠন হাতেগোনা কয়েকটিই রয়েছে। তবে একইসাথে ভালো এবং খারাপের পরস্পর বিরোধী পরিচিতি অন্য কোনো গুপ্ত সংগঠনের ভাগ্যে জোটেনি। কারও কারও মতে, নাইটস টেম্পলাররা খ্রিস্টধর্মের রক্ষাকর্তা, তাদের কাছেই রয়েছে হলি গ্রেইল এবং আর্ক অফ দ্য কোভানেন্টের মতো ঐতিহাসিক রেলিক, খ্রিস্টধর্মকে রক্ষা করতে তারা নিজেদের জীবন বাজি রেখেছে, পবিত্র ভূমিকে রক্ষা করতে ছুটে গিয়েছে ইউরোপ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে, গরীব আর তীর্থযাত্রীদেরকে আগলে রেখেছে দস্যুদের কাছ থেকে।
আবার সম্পূর্ণ বিপরীত গুজবও রটেছে এই রহস্যময় গুপ্তদলকে নিয়ে। অনেকের কাছে নাইটস টেম্পলারদের পরিচয় ধর্মের আড়ালে লুকিয়ে থেকে বিধর্মীদের দলে যোগ দেওয়া একদল বিশ্বাসঘাতক। তাদের মতে, নাইটস টেম্পলারদের সাথে আরেক গোপন দল ‘হাশাশিন’ এর সম্পর্ক ছিল, এমনকি এমন গুজবও ছড়িয়েছে যে, তারা গোপনে শয়তান ‘ব্যাফোমেট’-এরও পূজা করতো! খ্রিস্টধর্মকে ব্যবহার করে অঢেল সম্পদের মালিক হওয়া নাইটস টেম্পলারদের নিয়ে কন্সপিরেসি থিওরিও কম নয়। ফ্রিম্যাসনসহ আরও অন্যান্য গুপ্তসংঘের সাথে নাইটস টেম্পলারদের সম্পর্ক মেলানোর চেষ্টা করেছেন অনেকেই।
ধ্যযুগীয় এই রহস্যময় গুপ্তসংঘ নিয়ে জল্পনা-কল্পনারও শেষ নেই। সেই ভিক্টোরিয়ান যুগের ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস ‘আইভানহো’ কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে ড্যান ব্রাউনের ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’, সবকিছুতেই উঠে এসেছে নাইটস টেম্পলারদের রহস্যময় উপাখ্যান। কিন্তু আসল নাইটস টেম্পলার কারা? তাদের সাথে কি আসলেই গোপন কিছুর সম্পৃক্ততা রয়েছে? তারা কি আদপেই রহস্যময়, নাকি তাদেরকে এভাবেই উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে? তবে চলুন জেনে আসা যাক লাল ক্রুশ আর সাদা আলখেল্লার মধ্যে লুকিয়ে থাকা নাইটস টেম্পলারদের গোপন রহস্য।
ভ্রাতৃসংঘে স্বাগতম:
পোপ দ্বিতীয় আরবানের ডাকে সাড়া দিয়ে ইউরোপ থেকে হাজার হাজার খ্রিস্টান ছুটে গেল জেরুজালেমের দিকে, মুসলিমদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে হবে নিজেদের পবিত্র ভূমি। সিরিয়া থেকে ফিলিস্তিনের বিশাল পথ হেঁটেই পাড়ি জমালো তারা, অবরোধ করে রাখলো পুরো শহর। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে অবরোধ করে রাখার পর অবশেষে জেরুজালেমে ঢুকে পড়লো ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত যোদ্ধারা, মুসলিম-ইহুদীদের উপর চালানো হলো ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ। সাড়ে চারশো বছর পর আবারও পবিত্র ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হলো ক্রুশের শাসন। জেরুজালেমে ল্যাটিন খ্রিস্টান রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ‘চার্চ অফ দ্য হলি সেপালচার’-এ রক্ষিত যীশু খ্রিস্টের সমাধিতে প্রার্থনার জন্য ইউরোপ থেকে তীর্থযাত্রীরা ভিড় জমাতে থাকলো। কিন্তু সমস্যা হলো একটাই, সোনাদানা আর মূল্যবান জিনিসের লোভে এই তীর্থযাত্রীদের উপর প্রায়ই হামলা হতে থাকলো, জাফফা বন্দর থেকে জেরুজালেমের সরু রাস্তা রক্তাক্ত হয়ে গেলো এই তীর্থযাত্রীদের রক্তে। এমন পরিস্থিতিতেই হিউ দ্য পায়ান্স নামের এক ফরাসী নাইট সিদ্ধান্ত নিলেন, এমন একটি দল গঠন করবেন যারা তীর্থযাত্রীদেরকে ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা করবে, অস্ত্র ধরবে জীবন রক্ষার জন্য।
১১১৯ সালের বড়দিন চলে আসলো, প্রথম ক্রুসেডের পর ২০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। টেম্পলার গ্র্যান্ডমাস্টার হিউ দ্য পায়ান্স তার মতো আরও ৮ জন খুঁজে পেলেন। যীশুর জন্মবার্ষিকীতে চার্চ অফ দ্য হলি সেপালচারে রাখা যীশুর সমাধির পাশে ৯ জন শপথ নিলেন খ্রিস্টধর্মের জন্য নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিবেন। জীবনধারণ করতে হবে গরীবদের মতো, নারীসঙ্গ থেকে দূরে থাকতে হবে আর সর্বদা টেম্পলার গ্র্যান্ডমাস্টারের প্রতি অনুগত থাকতে হবে, এই তিনটিই ছিল নাইটস টেম্পলার হওয়ার জন্য শপথের মূল কথা। সন্ন্যাসী আর নাইট, দুটোই একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীত, কিন্তু নাইটস টেম্পলার তৈরি হওয়ার পর এই দুটো পেশাই এক জায়গায় হয়ে গেলো। সন্ন্যাসীদের মতো জীবনধারণ আর সিংহের মতো লড়াই, খ্রিস্টধর্মের সেবা করার জন্য এর চেয়ে উত্তেজনাকর আর কীইবা হতে পারে?
গ্র্যান্ডমাস্টার হিউ দ্য পায়ান্সের সাথে জেরুজালেমের রাজা দ্বিতীয় বোল্ডউইনের ঘনিষ্ঠতা আগে থেকেই ছিলো। তাই তাকে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পেয়ে বেশ ভালোই সুবিধা হলো নাইট টেম্পলারদের। রাজা তাদেরকে থাকার জায়গা করে দিলেন মাউন্ট টেম্পলে। খ্রিস্টান কিংবদন্তী অনুযায়ী, আল আকসা মসজিদ গড়ে উঠেছে রাজা সলোমনের পবিত্র মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপরেই! এবং এখান থেকেই হিউ দ্য পায়ান্স তার সংগঠনের নাম ঠিক করলেন, ‘দ্য পুওর ফেলো সোলজারস অফ ক্রাইস্ট অ্যান্ড অফ দ্য টেম্পল অফ সলোমন’– কিংবা সংক্ষেপে ‘নাইটস টেম্পলারস’। নাইটস টেম্পলারদেরকে নিয়ে এ সময় থেকেই বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে পড়েছিলো- নাইটরা সম্ভবত মাউন্ট টেম্পলের নিচের কোনো গোপন সুড়ঙ্গ খুঁজে পেয়েছে যেখানে রয়েছে রাজা সলোমনের বিশাল সম্পদ, সেই সঙ্গে রয়েছে ‘আর্ক অফ দ্য কোভানেন্ট’ আর ‘হলি গ্রেইল’-ও!
গুজব যা-ই হোক না কেন, শুরুতে নাইটস টেম্পলাররা নাম আর কাজ, উভয় দিক থেকেই ছিল কপর্দকশূন্য। তারা নিজেদের সাথে কোনোরকম টাকা-পয়সা বহন করতে পারতো না, সপ্তাহে মাত্র তিনবার মাংস খাওয়ার অনুমতি মিলতো, আর থাকা-খাওয়া সহ নিজেদের প্রয়োজনের সবটুকুই মেটাতে হতো তাদের কাছে পাঠানো অল্প কিছু দান-খয়রাত থেকে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই নাইটস টেম্পলারদের নামের পাশে যুক্ত হতে থাকলো ভারী ভারী সব নাম। বার্নার্ড দ্য ক্লেয়ারভোয়াঁ ছিলেন এমনই একজন, ইউরোপের চার্চে প্রভাবশালী এবং একইসাথে বেশ ধনী এই ব্যক্তি ভ্রাতৃসংঘের প্রথম নয় ভাইয়ের একজনের ভাতিজাও ছিলেন। ক্লেয়ারভোয়াঁর সহায়তায় পোপের সম্মতি পেয়ে গেলো নাইটস টেম্পলাররা। এর ফলে তারা একদিকে যেমন শুধুমাত্র তাদের কাজের জন্য পোপের কাছে জবাবদিহি করার সুযোগ পেলো, অন্যদিকে এর ফলে নাইটস টেম্পলারদেরকে সাহায্য করতে হাত বাড়িয়ে দিলো পশ্চিম ইউরোপের ধনিক সমাজ, যারা ক্রুসেডে সহায়তাকারীদের নামের তালিকায় নিজেদের নাম দেখতে চাইতো।
দুর্ধর্ষ বাহিনী:
নাইটস টেম্পলার গঠিত হওয়ার ১০ বছরের মাথায় পোপের অনুমতি পাওয়া এই বাহিনী হঠাৎ করেই ফুলে ফেঁপে উঠতে শুরু করলো। ইউরোপের সেরা সেরা যোদ্ধারা নাইটস টেম্পলারে যোগ দিলো। উন্নত অস্ত্রশস্ত্র আর প্রশিক্ষণের যন্ত্রপাতি যুক্ত হতে থাকলো নাইটস টেম্পলারদের অস্ত্রশালায়। প্রত্যেক নাইটকে নিজের যুদ্ধ করার দক্ষতা দেখিয়েই তারপর ‘টেম্পলার নাইট’ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হতো, আর তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্বে ছিলো সেরা তলোয়ারযোদ্ধারা। প্রত্যেক নাইটকেই তিনটি করে ঘোড়া দেওয়া হতো। একটি তার নিজের জন্য, আরেকটি তার সার্জেন্ট এবং শেষটি স্কয়ারের জন্য। এভাবে প্রতি নাইটের সাথে আরও দুজন প্রশিক্ষণার্থী নিজেদের দক্ষতা ঝালাই করে নেওয়ার সুযোগ পেতো। এভাবে কিছুদিনের মধ্যেই তুখোড় একদল বাহিনী গড়ে উঠলো নাইটস টেম্পলারদের তত্ত্বাবধানে। তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত মুসলিম ইতিহাসবিদ ইবনে আল আসিরের ভাষায়, “ফ্রাংকদের মধ্য তারাই ছিল সবচেয়ে দুর্ধর্ষ বাহিনী।” (‘ফ্রাংক’ বলতে বোঝানো হয়েছে পবিত্র ভূমিতে অবস্থান করা পশ্চিমা খ্রিস্টানদেরকে।)
কিছুদিনের মধ্যেই টেম্পলাররা আর জেরুজালেমের তীর্থযাত্রী রক্ষার কাজে সীমাবদ্ধ রইলো না, বরং তারা পুরো খ্রিস্টান জগতকেই রক্ষা করতে ইউরোপের এ মাথা থেকে সিরিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লো। গাজা উপত্যকার দুর্গ নিজেদের করায়ত্ব করলো, মুসলিম সৈন্যদেরকে পশ্চিম সিরিয়ার পাহাড় পর্যন্ত পিছিয়ে যেতে বাধ্য করলো। স্পেন আর পর্তুগালে আঞ্চলিক টেম্পল স্থাপন করা হলো, স্প্যানিশ আর পর্তুগিজ খ্রিস্টানদের সাথে একসাথে নেমে পড়লো আল-আন্দালুস থেকে মুসলিম শাসন উচ্ছেদ করতে।
যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো নাইট কখনোই আত্মসমর্পণ করতে পারবে না, যতক্ষণ না টেম্পলারদের ক্রুশ আঁকা পতাকা ধুলোয় গড়াগড়ি খাবে, আর তারপরও, যদি সুযোগ থাকে তবে যুদ্ধক্ষেত্রের অন্য খ্রিস্টান অর্ডার (যেমন: নাইটস হসপিটালার) এর সাথে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে মৃত্যুর আগপর্যন্ত। যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে পালানো মানে টেম্পলার হাউজ থেকেই বহিষ্কৃত হওয়া। তাছাড়া, টেম্পলার নাইটদের কাছে যুদ্ধে মৃত্যু খুবই সম্মানীয় একটি বিষয়। তাদের বিশ্বাসমতে, এর ফলে তারা সরাসরি স্বর্গে প্রবেশ করবেন। তাই পুরো পবিত্র ভূমিতে টেম্পলারদের লাল-ক্রুশ আঁকা সাদা আর কালো আলখেল্লা মোড়ানো এই মৃত্যুভয়হীন নাইটদেরকে সমীহ করে চলতো সবাই।
তুর্ক সুলতান ইমাদ-আল-দ্বীন জেঙ্গির এডেসা শহর দখলের ফলশ্রুতিতে তা পুনরায় দখল করতে পোপ তৃতীয় ইউজেন দ্বিতীয় ক্রুসেডের (১১৪৭-১১৫০) ডাক দেন, কিন্তু তাতে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে নেয় ক্রুসেডাররা। মুসলিম বাহিনীর ২০ হাজার সৈন্যের বিপরীতে খ্রিস্টানদের সৈন্য মারা যায় প্রায় দুই লক্ষ! এমনই এক অভিযানে, ফরাসী রাজা সপ্তম লুইয়ের নেতৃত্বে ফরাসী যোদ্ধারা তুরস্কের দিকে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু পথিমধ্যেই তুর্কি ঘোড়সওয়ারদের উপর্যুপরি হামলায় মুহূর্তের মধ্যেই বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে পুরো বাহিনী, কয়েক শত সৈন্য কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারা যায়। যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা দেখে পাথরের পেছনে আত্মগোপন করেন রাজা ফিলিপ! এমন সময় গিলবার্ট নামের এক টেম্পলার সৈন্যবাহিনীর দায়িত্ব নেয়, পুরো বাহিনীকে ছোট ছোট দলে ভাগ করে প্রতিটি দলে একজন টেম্পলার নাইটকে সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেয়। আক্রমণের মুখেও কীভাবে আক্রমণ প্রতিহত করে পিছু হটা যায়, তা-ই কিছুক্ষণের মধ্যেই শিখিয়ে দিয়ে নিরাপদে ফরাসী সৈন্যদলকে পবিত্র ভূমিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এভাবে মাত্র ৫০ জন টেম্পলারের ভূমিকায় বিশাল হতাহতের আশঙ্কা থেকে বেঁচে যায় ফরাসীরা।
রাজা লুইয়ের এই নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের পর টেম্পলারদের উপর আরো নির্ভর করতে থাকা শুরু করে ইউরোপীয় খ্রিস্টান রাজারা। তাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয় গাজার দক্ষিণে থাকা দুর্গ রক্ষা করতে, এশিয়া মাইনর থেকে ইউরোপের প্রবেশদ্বার অ্যান্টিওক নিজেদের দখলে রাখতে, এমনকি পবিত্র ভূমির যেকোনো প্রতিরক্ষার জন্য টেম্পলারদেরকে স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়। এই দুর্ধর্ষ বাহিনীকে তাই সমঝে চলতো হাশাশিনরাও, ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ানো এই ইসমাইলীয় আততায়ীরা নিজেদের কাজ নির্বিঘ্নে কাজ করার জন্য টেম্পলারদেরকে নিয়মিতভাবে বেশ মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে নিজেদের রাস্তা পরিষ্কার রাখতো।
হাত্তিনের যুদ্ধে, সালাদিন-এর বিরুদ্ধে:
৪ জুলাই, ১১৮৭। সালাহ-আদ-দ্বীন, সিরিয়া আর মিশরের সুলতান তার ছেলে আল-আফদালকে সাথে নিয়ে তাকিয়ে আছে যুদ্ধক্ষেত্রের অপর পাশের একটি লাল তাঁবুর দিকে। সুলতানের চেহারা চিন্তায় ফ্যাকাসে হয়ে আছে। তাঁর যোদ্ধারা কয়েক ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ করছে, অসহনীয় গরম, ধুলা আর ধোঁয়ার মধ্যেই নিজেদের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। হাজার হাজার ঘোড়া আর বর্মে ঢাকা ক্রুসেডারদের মৃতদেহ পড়ে আছে পুরো মাঠজুড়ে। শত্রু, খ্রিস্টান রাজা গী অফ জেরুজালেমের নেতৃত্বে ছুটে আসা বিশাল বাহিনী দাঁড়াতেই পারেনি তাঁর বাহিনীর সামনে, কিন্তু ঐ লাল তাঁবুর পতন না হলে তাঁর বিজয় পরিপূর্ণ হবে না।
উৎফুল্ল আল-আফদাল চিৎকার করে উঠলো, “খ্রিস্টান বাহিনী পিছু হটছে।” “শান্ত হও!” সালাহ-আদ-দ্বীন ধমকে উঠলো। “আমরা এখনো তাদেরকে হারাতে পারিনি, ঐ তাঁবুর পতন হয়নি এখনো।” কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর চিন্তা আনন্দে রূপ নিলো, মুখ থেকে ভেসে আসলো ‘আল্লাহু আকবার’। তাঁবুর ভেতর থেকে রাজা গী-কে ধরে নিয়ে আসা হচ্ছে, খ্রিস্টানদের সবচেয়ে পবিত্র রেলিক, ‘ট্রু ক্রস-এর খণ্ডাংশ’-ও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। বেঁচে থাকা ক্রুসেডারদেরকে ধরে নিয়ে আসা হলো দাস হিসেবে বিক্রি করার জন্য, অভিজাতদের ছাড় দেওয়া হলো মুক্তিপণের বিনিময়ে।
কিন্তু ছাড় পেলো না টেম্পলাররা। ঘোষণা করা হলো, যে ব্যক্তি একজন নাইটকে সুলতানের সামনে হাজির করতে পারবে, হোক সে টেম্পলার কিংবা হসপিটালার, তাকেই ৫০ দিনার পুরষ্কার দেওয়া হবে। টেম্পলার নাইটরা কী করতে পারে তা সম্পর্কে খুব ভালো ধারণাই ছিল সালাহ-আদ-দ্বীনের। অন্যান্য খ্রিস্টানরা যদিওবা ক্ষমা ভিক্ষা করতে পারে কিংবা মুক্তিপণের মাধ্যমে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করতে পারে, নাইটস টেম্পলাররা কখনোই তা করবে না। তাছাড়া ১০ বছর আগে মন্টগিসার্ডের যুদ্ধে এই টেম্পলারদের কাছেই শোচনীয়ভাবে হারতে হয়েছিলো তাঁকে। মাত্র ৫০০ টেম্পলার নাইট আর তাদের সাথে কয়েক হাজার সৈন্য মিলে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলো পুরো মামলুক বাহিনীকে। ২৬ হাজার যোদ্ধার প্রায় ৯০ শতাংশই মারা পড়েছিলো এই টেম্পলারদের হাতে, এজন্য বেদুইনদের কাছে কম বিদ্রূপও শুনতে হয়নি তাঁকে!
সালাহ-আদ-দ্বীনের ব্যক্তিগত সহকারী আর জীবনীলেখক ইমাদ আল-দ্বীনের ভাষায়, “এই ফ্রাংকরা কখনোই শত্রুতা পরিত্যাগ করবে না, এবং দাস হিসেবেও অবাধ্য… তাই তিনি প্রত্যেক টেম্পলারের ধড় থেকে মাথা আলাদা করে ফেলার আদেশ দিলেন…।”
কিন্তু পেশাদার জল্লাদ নয়, সালাহ-আদ-দ্বীন তার সাথে থাকা সাধারণ মানুষ, যাদের এ ধরনের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই, তাদেরকে এ কাজ করার অনুমতি দিলেন। মুসলিমদের সবচেয়ে বড় শত্রু এই টেম্পলারদেরকে খুন করতে তাই এগিয়ে এলো সুফি, আইনজীবী আর পণ্ডিতরা। কয়েকজন খুব দ্রুতই তাদের কাজ শেষ করে ফেললেন, কিন্তু কয়েকজন অনভিজ্ঞ তাদের ভোঁতা তলোয়ার দিয়েই টেম্পলারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন! ইমাদ আল-দ্বীন লিখেছেন, “কয়েকজন এতটাই অদ্ভুতভাবে তলোয়ার চালাচ্ছিলো যে শেষপর্যন্ত অন্যদের দিয়ে কাজ শেষ করতে হয়েছিলো!” সালাহ-আদ-দ্বীন বাগদাদে চিঠি পাঠালেন, “একজন টেম্পলারও আর বাঁচেনি,” এবং তিনি প্রায় ঠিকই লিখেছিলেন। তাঁর এই আদেশ দেওয়ার পেছনে আরো একটি প্রধান কারণ ছিলো যেন টেম্পলাররা আর কখনোই মুসলিমদের বিরুদ্ধে উঠে না দাঁড়াতে পারে।
ব্যাংকার টেম্পলার:
হাত্তিনের যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর জেরুজালেমও ক্রুসেডারদের হাত থেকে চলে যায় মুসলিমদের হাতে। ঠিক ৫ বছর পরেই তৃতীয় ক্রুসেডের মাধ্যমে অ্যাকার শহর সহ পবিত্র ভূমির বেশ কিছু এলাকা পুনরায় দখল করে নেয় রিচার্ড দ্য লায়নহার্টের নেতৃত্বে থাকা ক্রুসেডাররা; যদিও তারা জেরুজালেম দখল করতে পারেনি। টেম্পলাররা তাদের নতুন আস্তানা গাড়ে বন্দরনগরী অ্যাকারে। সেখান থেকেই পরিচালিত হতে থাকে বাহিনীর কার্যক্রম। কিন্তু যুদ্ধে প্রচুর লোকবল হারানোর কারণে টেম্পলারদের উঠে দাঁড়াতে বেশ সময় লেগে যায়। এমন সময়ই অ্যাকার শহর পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় আরেক মিলিটারি অর্ডার ‘নাইটস হসপিটালার’-দের। শুরু থেকেই টেম্পলার আর হসপিটালারদের মধ্যে রেষারেষি ছিল, এ ঘটনার পর থেকে এই রেষারেষি আরো বেড়ে যায়।
পরাজয় ঘটলেও ইউরোপের জনসমাজের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলো নাইটস টেম্পলাররা। অনেকটা প্রাচীন ব্যাংকিং সুবিধার প্রচলন ঘটিয়েছিলো তারা। তীর্থযাত্রীরা তাদের নিজেদের মূল্যবান ধন-সম্পদ ইউরোপের টেম্পলার হাউজে জমা রেখে যেতে পারতো, এর বিনিময়ে তাদেরকে একটা ক্রেডিট নোট ধরিয়ে দেওয়া হতো, এটি দেখালেই তারা জেরুজালেমের টেম্পলার হাউজ থেকে ঐ সম্পদের সমপরিমাণ সম্পদ আবার ফেরত পেতো। এর মানে হচ্ছে, পবিত্র ভূমির অনিরাপদ জায়গাগুলোতে তাদেরকে তাদের মূল্যবান সম্পদ চুরি হয়ে যাওয়ার কোনো ভয় থাকতো না। এমন গুজবও ছড়িয়েছে যে, টেম্পলাররা তাদের ব্যাংক নোটে বিশেষ ধরনের গোপন কোড লিখে দিতো, যার ফলে তারা বুঝতে পারতো নোটের আসল মালিক কে। ইউরোপের অভিজাত লোকেরাও ক্রুসেডে যোগ দেওয়ার আগে তাদের জমিজমা-সম্পত্তি টেম্পলারদের হেফাজতে রেখে যুদ্ধে যোগ দিতো।
ধন-সম্পদ লেনদেন করার ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিশাল সম্পত্তির মালিক বনে যায় টেম্পলাররা। এছাড়া অভিজাত আর গণ্যমান্যদের সাথেও তাদের আর্থিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জমিজমা, আঙ্গুরক্ষেত কিনে নেয় তারা, আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা শুরু করে, যুদ্ধের সময় রাজাদের ধার দেওয়া শুরু করে, গড়ে তোলে নিজেদের বিশাল জাহাজ বহর, এমনকি সম্পূর্ণ সাইপ্রাস দ্বীপও রিচার্ড দ্য লায়নহার্টের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলো তারা! যদিও পরবর্তীতে তেমন কাজে না লাগায় তা পুনরায় বিক্রি করে দেয়।
দুই মহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা টেম্পলারদের এই সম্পদ আর ক্ষমতা সহজেই নাইটস হসপিটালার আর টিউটনিক নাইটদের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারচেয়েও বড় কথা, এখন ইউরোপের ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা তাদের কাছে ঋণগ্রস্ত!
নাইটস টেম্পলারদের গোপন রহস্য
Reviewed by Khalilur Qaderi
on
May 20, 2018
Rating:
